আগামীকাল ১৩ জানুয়ারি রশিদ আহমদ নঈমী আল-মাইজভান্ডারীর বার্ষিক ইছালে ছাওয়াব মাহফিল (সালানা ওরছ)

আগামীকাল শনিবার ১৩ জানুয়ারি রাহনুমায়ে শরীয়াত ও তরিকত, মোনাজেরে আহলে সুন্নাত আল্লামা শাহ রশিদ আহমদ নঈমী আল-মাইজভান্ডারীর বার্ষিক ইছালে ছাওয়াব মাহফিল (সালানা ওরছ) রাউজান নোয়াপাড়া শেখপাড়াস্থ রশিদ ভান্ডার দরবার শরীফে অনুষ্টিত হবে।

রাহনুমায়ে শরীয়াত ও তরিকত, মোনাজেরে আহলে সুন্নাত আল্লামা শাহ রশিদ আহমদ নঈমী আল-মাইজভান্ডারী (রাদিয়াল্লাহু আনহু’র) জীবন ও কর্ম।
**************************************
(শ্রদ্ধেয় নানাজান স্মরণে)
মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ রশিদীঃ
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে পথহারা মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য অসংখ্য নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআন মাজীদে কতেক নবী-রাসুলের বর্ননা রয়েছে আরো অনেকের নাম কুরআন মাজীদে নেই। হযরত আদম (আ.)’র মাধ্যমে নবী আগমনের ধারা সূচিত হয়ে আখেরী নবী সাইয়্যেদুল মুরছালিন হযরত মুহম্মদ (দ.) এর মাধ্যমে নবুয়্যতের ধারা পরিসমাপ্তি ঘটে।

বর্তমানে পথহারা মানুষের হেদায়েতের জন্য নবীর উত্তরাধিকারী হিসেবে আউলিয়ায়ে কেরাম দায়িত্ব পালন করবেন। হাদীস শরীফে আছে,- নবীজিব(দ.) এরশাদ করেছেন- “আমার উম্মতের হক্বানী আলেমগণ বনী ইসরাইলের নবীগনের তুল্য।” বনী ইসরাইলের অনেক নবীগন যত কাজ করেনি (হেদায়াতের ব্যাপারে) আখেরী রাসুল (দ.) এর উম্মতের আলেমগন অধিক মানুষের পথের সন্ধান দান করবেন, হেদায়েতের রাস্তা দেখাবেন।

এখানে হযরত নূহ (আ.) ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। ইতিহাসে রয়েছে- নূহ নবী (আ.) নয়শত বছর হেদায়েত করে শুধুমাত্র ৮০ জন মানুষকে হেদায়েতের পথে এনেছেন তৎমধ্যে চল্লিশজন নারী ও চল্লিশজন পুরুষ। প্রিয় রাসুল (দ.)’র উম্মতের অনেক বুজুর্গ আলেম লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইমানের আলো দান করেছেন।

জন্ম ঃ আউলিয়া কেরামের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত, রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া, শেখপাড়া গ্রামে বনেদি পরিবারে হযরত জয়নুদ্দীন মিয়াজী (রহ:) ঘর আলোকিত করে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ১৯১০ খিস্টাব্দে রাসুলের উত্তরসূরী, হেদায়তের দিকপাল, মোনাজেরে আহলে সু্ন্নাত, হযরত আল্লামা শাহ রশিদ আহমদ নঈমী আল মাইজভান্ডারী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ক্ষনজন্মা মহা মনীষী জন্ম গ্রহণ করেন। মাওলানা রশিদ আহমদ শাহ (রা.)’র পিতা হযরত জয়নুদ্দীন মিয়াজী (রাহ:) ছিলেন তৎকালীন বৃটিশ আমলে রাউজানে নামকরা পরিচিত, হিতৈষী, ও জনদরদী ব্যক্তি। গাউসুল আজম হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (রা.)’র একনিষ্ট মুরিদ ছিলেন। অত্র অঞ্চলে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত ছিল না। লোকেরা ইউনানী-কবিরাজী চিকিৎসা গ্রহন করে আরোগ্য লাভ করতেন। হযরত জয়নুদ্দীন মিয়াজী (রাহ:) হাড়ভাঙ্গা চিকিৎসায় বিখ্যাত একজন ইউনানী চিকিৎসক ছিলেন। এলাকায় উনার নামের সুখ্যাতি ছিল।

শিক্ষাজীবন ঃ বাল্য বয়সে এলাকার মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে জয়নুদ্দীন মিয়াজি (রাহ.) প্রিয় সন্তানকে রাউজানের গশ্চি গ্রামে প্রখ্যাত আলেম ও বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব, ভারতের আশরাফী সিলসিলার খলিফা হযরত মাওলানা হাছান আলী আল আশরাফী (রা.) ‘র নিকট ইসলামের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞান অর্জন করার জন্য প্রেরণ করেন। বলা বাহুল্য, তৎকালীন কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের জন্য কোন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। তাই মাওলানা হাছান আলী আল আশরাফী (রা.) এর ঘরেই তিনি দ্বীনি শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেন। গশ্চি গ্রামে ইসলামের বিভিন্ন শাখায় প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের পরে আধুনালুপ্ত মহসেনিয়া মাদরাসা বর্তমান মহসিন কলেজ এ মাদরাসায় ভর্তি হয়ে তখনকার প্রখ্যাত বুজুর্গ আলেমদের নিকট জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন। ভারত উপমহাদেশের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলিকাতা আলীয়া মাদরাসায় হাদীস শাস্ত্রের উপর অধিকতর গবেষণার জন্য ভর্তি হয়ে ১৯৩২ ইং সনে কামিল (হাদীস) এ প্রথম শ্রেনী অর্জন করেন।

শিক্ষকতা ঃ দ্বীনি শিক্ষা শেষান্তে ভারতের প্রখ্যাত আলেমকুল শিরমনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর ধারক বাহক সাদরুল আফাজেল আল্লামা নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)’র প্রতিষ্ঠিত দরসে নেজামিয়া মাদরাসায় হাদিসের অধ্যাপনা আরম্ভ করেন। মুরাদাবাদ থাকাকালীন আল্লামা নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রা.)’র কাছে ত্বরিকতের তালিম গ্রহণ করত: খেলাফত প্রাপ্ত হন। ভারতের প্রখ্যাত বুজুর্গ আল্লামা আবুল খায়ের বেনারশী (রা) সহ আরো ৫জন বুজুর্গ পীর ত্বরিকতের খেলাফত প্রদান করেন। উনি প্রায়শই বলতেন, “আমি রশিদ আহমদ সাত পীরের খেলাফত প্রাপ্ত।” এতদসত্বেও কেহ উনার মুরীদ হবার জন্য বাড়ীতে আসলে বলতেন, “হাশরের ময়দানে আমি আমার গোনাহ নিয়ে কোথায় যাব জানিনা, তোমাদের বোঝা আমি কিভাবে মাথায় নেব।” উনার এ কথাটা কুরআন মাজীদের আয়াত শরীফ, আল্লাহ বলেন, “আমি আজ এ দিনে (হাশরে) প্রত্যেক মানুষকে তাদের ইমামসহ ডাকব।” তিনি প্রচলিত পীর মুরিদী পছন্দ করতেন না বরং পীর হয়ে মুরিদের দুনিয়া আখেরাতে কল্যান করার পীর মুরিদীতে বিশ্বাসী ছিলেন। ভারত হতে বাংলাদেশ আগমন করে প্রথমে কয়েকটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। পরবরর্তীতে গশ্চি উচ্চ বিদ্যালয়ের পার্শ্বস্থ গশ্চি ভানুমতি সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষকতা করে অবসর গ্রহণ করেন। মাধ্যমিক বিদ্যালয় সমূহে অতীতে আরবী, ফার্সী ও উর্দু প্রচলন ছিল। উনি প্রথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি গশ্চি উচ্চ বিদ্যালয়েও আরবী,ফার্সী ও উর্দু ক্লাস নিতেন।বর্তমানে উনার অসংখ্য ছাত্র দেশের নানান জায়গায় কর্মরত।

বিবাহ ও সন্তানাদীঃ প্রথমে তিনি বেতাগী দরবারের প্রতিষ্ঠাতা পীরে তরিকত আল্লামা হাফেজ বজলুর রহমান মোহাজেরে মক্কী (রা.)’র কন্যার ঘরের নাতনী মরহুম ছৈয়দুল হক বৈদ্য এর কন্যা হযরত সৈয়দা সায়রা খাতুন (রাহ.)কে শাদী করেন। তিনি নি:সন্তান অবস্থায় ইন্তেকাল করলে ২য় বিবাহ করেন তৎকালিন চট্টগ্রাম মহসেনিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ, প্রাচীনকালের অনেক আলেমের ওস্তাজ বিশেষত: সাতকানিয়ার মাওলানা নজীর আহমদ শাহ (রাহ:) গারাঙ্গীয়ার বড় হুজুর মাওলানা আবদুল মজিদ শাহ (রাহ:)সহ অনেক প্রবীন আলেমের শিক্ষাগুরু, মোজাদ্দেদীয়া সিলসিলার পীর,কদুরখীল নিবাসী মধ্যযুগীয় কবি হযরতুল আল্লামা কাজী আবদুল মাজীদ ইসলামাবাদী (রাদিয়াল্লাহু আনহু)প্রকাশ বড় মাওলানা’র নাতনী ও কদুরখীলের প্রখ্যাত আলেমকুল শিরমনী হযরত মাওলানা আবদুর রশীদ (রাহ:) কন্যা মাহতারামা কাজী রহীমা খাতুন (রাহ:) কে পরিণত বয়সে শাদী করেন। এ ঘরে উনার ছয় কন্যা ও দুই ছেলে জন্মগ্রহণ করে। বর্তমানে উনার বড় সাহেবজাদা অধ্যাপক ও এডভোকেট এ.ইউ.এম আতহার মিয়া সাহেব (মা.জি.আ) ও ছোট সাহেবজাদা মাওলানা এ.জে.এম. আজহার মিয়া আল মাইজভান্ডারী (মা.জি.আ) সাহেব রয়েছেন।

মোনাজেরা বা বাহাছঃ ইসলামী বিষয়ে কোন মতবিরোধ পরিলক্ষিত হলে ভিন্ন মতবলম্ভীদের সাথে কুরআন, হাদীস,ইজমা,কিয়াস ও শরীয়তের ফয়সালার ভিত্তিতে যেকোন জায়গার যেকোন সময়ে উপস্থিত হতেন। চাই হোক দিন বা রাত। বর্তমানে যেকোন মতবাদের সাথে বিরোধীতা হয় একপেশে শুধুমাত্র বিরোধীতার খাতিরে বিরোধীতা। তৎকালীন সময়ে বুজুর্গ আলেমদের নিয়ত খালেছ ছিল সত্য প্রকাশই তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। কোন এক মোনাজেরায় রাউজানের দেওয়ানপুর গ্রামে অনেক লোকের উপস্থিত। লোকেরা বলতে লাগল আজকে আগুন জালায়ে দেব। মাওলানা রশিদ শাহ বললেন, “আমি আগুন নেভানোর জন্য এলম হাসেল করেছি। আগুন জ্বালানোর জন্য নহে। বিবাদ মিমাংসা আমার কাজ বিবাদ সৃষ্টি করা নয়।” যেকোন দাওয়াতে তিনি যেতেন না হালাল-হারাম বিবেচনায় নিয়ে দাওয়াত গ্রহন করতেন। যেকোন প্রভাব প্রতিপত্তির উর্দ্ধে গিয়ে সত্যটা সহসাই প্রকাশ করতেন জনসম্মুখে।

আমি আমার মায়ের কাছে শুনেছি, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি অন্যতম ব্যক্তিত্ব যে, নির্ভয়ে আপন ঘরে ছিলেন। নোয়াপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধ মরহুম খায়েজ আহমদ চেয়ারম্যান উনাকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন। খায়েজ আহমদ চেয়ারম্যান বলেন, হুজুর আপনি নিজের ঘরেই থাকবেন আমি খায়েজ আহমদ আছি। আপনি কারো কোন ক্ষতি করেননি, কোন অন্যায় কাজ আপনার জীবনে দেখিনি সুতরাং মতাদর্শ ভিন্নতা থাকাটা কোন দোষের না।

অত্র অঞ্চলের বিখ্যাত আলেম কাগতিয়া আলীয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পীরে কামেল আল্লামা রুহুল আমিন (রাহ:) এর সাথে খুবই বন্ধুত্ব ছিল। উনারা দুজন চট্টগ্রাম ও রাউজানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে করে প্রায় রাত মানুষকে হেদায়তের আলো ছড়ায়ে দিতেন। রাউজানের কয়েকটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় উনার অবদান রয়েছে। প্রচারভিমূখতাপূর্ন ছিল এ মনীষীর জীবনাচরণ ফলে কালের গর্বে এ সব মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় উনার নাম হারিয়ে গেছে।

তাসাওফ বা তরিকত গ্রহনঃ তরিক্বত ছাড়া শরীয়ত পূর্নতা পায়না । এ বিশ্বাস মনপ্রাণে তিনি সর্বদা ধারণ করতেন। বাংলাদেশে আসার পর হতে উনার কাছে তাসাওফের জ্ঞান অর্জন অতৃপ্ত থেকে যায়। পরিপূর্ণ কামালাত তথা বেলায়তের সোপান পাড়ি দেবার জন্য তিনি সর্বদা ব্যকুল ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি সামা মাহফিলের বিরোধীতা করতেন। বাবা ভান্ডারীর গায়েবীধন জীবনী ও কেরামত পুস্তিকাটির ৪১ পৃষ্টায় আছে, মাওলানা রশিদ আহমদ ছাহেবের সাথে মাইজভান্ডার দারবার শরীফের বাবাজান কেবলা নামে খ্যাত হযরত গোলামুর রহমান মাইজভান্ডারীর আদরের দৌহিত্র পীরে কামেল হযরত সিরাজুল ইসলাম প্রকাশ গায়েবীধন কেবলা (রাহ:)র সাথে প্রথম দর্শন হয় বার্মায় রেংগুন শহরে। উনি মাসিক মাহফিলে খানকাহ শরীফে হাজির থাকতেন । গায়েবীধন কিবলা কাবাকে বাবা ভান্ডারীর নাতি হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন এর বাইরে নয়। তবে মাইজভান্ডার দরবারের প্রতি দুর্বল ছিলেন। যেহেতু উনার বাবা হযরত কেবলা (রাহ) মুরীদ ছিলেন। একদা উনি গায়েবী ধন কেবলার হুজরা মাইজভান্ডারের আজিম নগর গ্রামে যাওয়ার মনস্থ করে দরবারে উদ্দেশ্যে গেলেন। গাড়ি হতে নামার সাথে সাথে উনার সমস্ত লতিফা আল্লাহু আল্লাহু জিকিরে স্পন্দন আরম্ভ হয়ে গেল। সাথে সাথে উনি গায়েবীধনের কাছে গিয়ে সব খুলে বলে উনার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে বললেল, “হুজুর আমি অনেক দিনের পিপাসী আজকে আমার পীপাসা মিটেছে।” উপস্থিত সবাইকে বললেন, তরীক্বতে জ্ঞান অর্জন ছাড়া শরীয়তের বাহ্যিক জ্ঞান কোন কাজে আসেনা তা আজকে আমি বুঝেছি। গায়েবীধন কেবলা উনাকে নিজের কাছে রেখে তরিক্বতের তালিম তরববিয়্যত প্রদান করত : খেলাফত প্রদান করলেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত গায়েবীধনের কাছে আসা যাওয়া করতেন।কেহ উনার মুরিদ হতে আসলে বলতেন, “আমার ভান্ডারী থাকতে আমি কিসের আবার পীর, এ বলে গায়েবীধনের দারবারে নিয়ে যেতেন মুরিদ করার জন্য।

 

চারিত্রিক বৈশিষ্টঃ মহান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল,সবর, ইলম-আমল,ইখলাস,রাসুল প্রেমের একজন খঁটি নিদর্শণ ছিলেন। জীবনে কোনদিন দু’দিনের খাবার যোগার করে রাখননি কখনো । আমার মা যদি কখনো বলতেন বন্যার সময় কিছু অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহে রাখেন প্রত্যুত্তরে তিনি বলতেন, জীবনে আমার আল্লাহ কোনদিন উপোষ রেখেছে প্রমান দিতে পারবে। নবিজী (দ.) এর সুন্নাতের পরিপূর্ণ অনুসরণে জীবন যাপন করতেন। প্রায়সই বলতেন, “আমি জীবনে কারো হক নষ্ট করিনি। কারো হকের উপর পা রাখিনি ইচ্ছা অনিচ্ছা যেকোন ভাবেই।” খুবই স্পষ্টভাষী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কাউকে ভালবাসলে আল্লাহর ওয়াস্তে ভালবাসতেন আর মন্দ বললেও আল্লাহর ওয়াস্তে বলতেন। ধনী ও ক্ষমতাশালীদের তার সম্পদ ও ক্ষমতার জন্য বিশেষ কদর করতেন না। লোক দেখানো কাজ ও ব্যক্তি খুশি করার কাজ মোটেও পছন্দ করতেন না। একদা নিরামিশ পাড়ায় একটি জানাযাতে বড় একটি মাদরাসার অধ্যক্ষকে জানাযা পড়ানোর জন্য আনা হলো। জানাযা শেষে উক্ত অধ্যক্ষ বাংলাতে মুনাজাত করছে। এমতাবস্থায় আল্লামা রশিদ আহমদ (রা.) চিৎকার করে বললেন, “আপনি না প্রেন্সিপাল বাংলায় কেন মুনাজাত করছেন? মানুষ খুশি করার জন্য। আমি রশিদ আহমদ ঘন্টা ঘন্টা আরবীতে মুনাজাত করতে পারবো।” এটা বলাতে উক্ত অধ্যক্ষ হাত ছেড়ে দিয়ে কাঁপতে লাগলো। হক আর আকিদার বেলায় কোন আপনজনকেও ছাড় দিতেন না। আবার দয়া ও সন্মানী ব্যক্তিকে সন্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কুসুমের মত কোমল হয়ে যেতেন। পূর্বে উল্লেখ করেছি, তিনি প্রাথমিক ইসলামী জ্ঞান অর্জন করেছেন গশ্চি গ্রামের প্রখ্যাত আলেম ও বুজুর্গ আল্লামা হাছান আলী আল আশারাফি (রা.)’র কাছে। উনার বড় ছেলে আল্লামা আমিনুল হক(রা.)। আল্লামা রশিদ আহমদ যে দাওয়াতে থাকতেন বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানগর্ব আলোচনা করতেন। তবে আল্লামা আমিনুল হক আল আশরাফি (রা.) থাকলে চুপ হয়ে নামাজের বৈঠকের মত বসে থাকতেন। আমার বড় ভাই মরহুম হাফেজ জহুর (রাহ.) জিজ্ঞাসা করতেন, নানা এখন চুপ কেন? তিনি উত্তরে বলতেন, এখানে আমার ওস্তাজ আমার মুনিবের ছেলে আছে বেয়াদবী হলে এলম কেড়ে নিয়ে যাবে। সুবহানাল্লাহ। শুধু ওস্তাজ নয় ওস্তাজের ছেলেকেও ওস্তাজের মত সন্মান করতেন।মাইজভান্ডার আজিম নগরে গাইবীধন কেবলার জেয়ারতে গেলে গাইবীধন মন্জিলের বর্তমান গদিনসীন হযরতুলহাজ্ব সৈয়দ আবুল মনসুর আল মাইজভান্ডারী (ম.জি.আ.) এর সাথে বেশ খোলামেলা আলোচনায় অনেক বিষয়ের বলেন, আপনার নানা গাইবীধনকে বলতেন, “আমি রশিদ আহমদ আপনার দরবারে মুরিদের কলা-মোলা,হাদিয়া পাবার আশায় আসিনি। এসেছি আল্লাহ এবং রাসুল (দ.) রেজামন্দি হাসিল করার জন্য এসেছি।”আমার বড় বোন সৈয়দা খাদিজা বেগম বলেন, আমরা ছোট বেলায় যখনই নানার বাড়িতে যেতাম নানা মাটি দিয়ে আমাদের মাধ্যমে ঢিলাকুলুপ তৈরী করাত এবং তা সব সময় লাই ভর্তি রাখত। এখানে সহজে অনুমেয় তিনি কতটুকু সুন্নাতের পাবন্দি ছিলেন। দু:খের বিষয় বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকে ঢিলাকুলুপ নেয়া ওহাবিদের কাজ বলে থাকেন নাউজুবিল্লাহ। অথচ আকাবেরে আহলে ছুন্নাতেরা পরিপূর্ন ছুন্নাতের অনুসারী ছিলেন।আমার ছোট খালা রোকেয়া বেগম সুঁই সুতার কাজ ভেশ ভাল জানেন। রোকেয়া খালা ঘরের দেয়ালে দেয়ার জন্য প্রজাপতির আল্পনা সুঁই সুতা দিয়ে তৈরী করে ঘরের দেয়ালে আয়না বাঁধিয়ে লাগিয়ে দিলেন। নানাজান দেখার সাথে সাথে খুলে ফেলেন এবং বললেন, এ সমস্ত ছবি হাশরের ময়দানে নির্মাণকারীর নিকট প্রান খোঁজবে। আরো বলতেন, যে সব ঘরে পুতুল ও প্রাণির ছবি আছে এসব ঘরের রহমতের ফেরেস্তা প্রবেশ করবেনা। মায়ের কাছে শুনেছি তিনি প্রায় রাত্রিবেলা কুরআন মাজিদ তেলাওয়াত করতেন। বলতেন মানুষের চল্লিশ বছর বয়সে চোখে চাল্লিশা লাগে। তজ্জন্য রাতেই বেশী কুরআন তেলাওয়াত কর। ফলে আশি বছর বয়সেই তিনি চশমা ছাড়া কুরআন মাজিদ তেলাওয়াত করেছেন। আজিবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেও তিনি অর্জিত কুরআন হাদিসের জ্ঞান একচুল পরিমাণও ভুলেননি। প্রমানস্বরূপ উনার কিতাব সমূহ দেখেছি যে, কিতাবের প্রত্যেক পাতায় পাতায় নিজের মাতামত ফার্সি ভাষায় কাটপেন্সিল দিয়ে লিখেছেন
যা আজো সংরক্ষিত আছে। যেকোন দাওয়াতে ইসলামী, আরবী গ্রামার, আরবী বিষয়ের যেকোন সমস্যা কেউ দিতে না পারলে তখন তা একমাত্র তিনিই সামাধান দিতেন। উনার সামনে কোন বক্তা কুরআন-হাদিসের কোন ভুল ইবারতে পড়লে বা কোন ভুল কথা সাথে সাথে বক্তাকে বসিয়ে দিতেন এবং বলতেন, দ্বীনি বিষয়গুলো খুবই সতর্কতার সহিত জাতিকে বলতে হয়, যাতে জাতি ভুল কিছু না শিখে। এজন্য উনাকে অনেক নামধারী আলেম উনাকে পছন্দ করতেননা। আজো অনেক তথাকথিত ওয়াজিন ওনার নাম শুনলেই মুখ কালো করে। বর্তমান সমাজে ভুল ওয়াজকারী ওয়াজিন বা বক্তাকে আমার জানামতে সঠিক বাতলিয়ে দেবার বা বসিয়ে দেবার আলেম নেই বললেই চলে।

রাহবারে শরীয়ত ও তরিকত আল্লামা শাহ রশিদ আহমদ নঈমী আল মাইজভান্ডারী (রা.) চারজন প্রখ্যাত বুজুর্গের খেলাফত পেয়েও পীর- মুরীদী থেকে একেবারে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন শুধুমাত্র আখেরাতে মুরীদের আমলের জবাবদিহীতার ভয়ে। যেহেতু আল্লাহ পাক কুরআন সুস্পষ্ট বলেছেন- “সেদিন আমি প্রত্যেককে তার ইমাম (নেতা)সহ ডাকবো। অর্থাৎ যে যার মুরিদ ছিল উক্ত পীর তারজন্য নেতা। পীর স্বীয় মুরীদকে রাস্তা দেখানোর প্রলোবনে পিছনে রেখেছে, মুরিদ করেছেন, ফলোয়ার করেছে। পীরের দায়িত্ব যথাযথ আঞ্জাম দিয়েছেন কিনা হাশরের ময়দানে এ পীর- মুরীদীর জবাবদিহীতার জন্য ডাকা হবে। না শুধু মুরীদের হাদিয়ার দিকে চেয়ে চেয়ে মুরীদকে সঠিক রাস্তা বাতলানো দূরের থাক নিজেও সঠিক রাস্তায় ছিল কিনা সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। এতসব জবাদিহীতার ভয়ে তিনি ভীত ছিলেন। তাই তিনি প্রচলিত পীর-মুরীদী বাদ দিয়ে আত্মশুদ্ধির জীবনে ব্যস্থ ছিলেন।

ফলে আল্লাহ পাক পুরস্কার হিসেবে ২৬ বছর পরেও কবরে কাপনের কাপরেও দাগ লাগেনি। অক্ষত রয়েছেন কবরে সুবহানাল্লাহ।

তিনি যেসব মনীষীদের থেকে খেলাফত লাভ করেন
০১. সাদরুল আফাজেল আল্লামা নঈমুদ্দীন মুরাদাবাদী (রা.)।
০২. হযরত আল্লামা আবুল খায়ের বেনারসি (রা.)।
০৩. মাইজভান্ডার দরবার শরীফের গায়েবীধন খ্যাত হযরত মাওলানা সিরাজুল ইসলাম প্রকাশ গায়েবীধন কেবলা (রা.)।
০৪. এ পীর সাহেবের নাম আপাতত আমার তথ্যে নেই। পরবর্তীতে জেনে প্রকাশ করবো।

অন্যদিকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা হতে কামিল ফার্স্ট ক্লাস পেয়েও দেশে এসে প্রথমে কয়েকটা মাদরাসায় শিক্ষকতা করে পরবর্তীতে আজিবন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে অবসর নেন ১৯৮৫ সালে।
উনাকে প্রশ্ন করা হলো- আপনি চাইলে বড় মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। এদিকে কেন গেলেন না। উত্তরে বলেছিলেন- আমি একখাতের টাকা অন্যখাতে ব্যয় করে, এক কাজের জন্য জনসাধারণ থেকে নিয়ে অন্যকাজে ব্যয় করে আখেরাতের বোঝা ভারী করবোনা। এ ভয়ে আমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় যাইনি।
উনার চিন্তাধারাকে নিয়ে বর্তমানে গবেষণার অবকাশ রাখে। তিসিস হবে যদি উনার চিন্তাধারা নিয়ে বর্তমানে গবেষণা করা হলে।

একটি সুস্বপ্ন (رويۃ الصالحۃ)ঃ

আমার “মা” এর কাছে শোনেছি- আমার মাতামহ আল্লামা শাহ রশিদ আহমদ আন নঈমী আল মাইজভান্ডারী (রা.)এর শ্রদ্ধেয় শ্বশুর যুগশ্রেষ্ট আলেম, কদুরখীল মুসলিম হাই স্কুলের সাবেক শিক্ষক ও বড় মাওলানা সাহেব (রা.) জ্যেষ্ঠ সন্তান আল্লামা আবদুর রশিদ (রা.)এর ইন্তেকালের পূর্বের রাতে আমার মরহুম নানাজান এক সুস্বপ্ন দেখেন যে, আল্লামা আবদুর রশিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু সাকারাতে আছেন এবং জামাতা আল্লামা রশিদ আহমদ আন নঈমী আল মাইজভান্ডারী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র শেষ হাতের পানি পান করার জন্য অপেক্ষারত আছেন। সকালে নিদ্রাভগ্ন হলে অতি সহসাথ কদুরখীল গ্রামে গিয়ে স্বপ্নে দেখা ঘটনার হুবহু দেখেন এবং উনার হাতের পানিটুকু পান করার সাথে সাথে মহান আল্লাহ’র সান্নিধ্যলাভ করেন। রাসুল (দ.) ইরশাদ করেন-“সুস্বপ্ন নবুয়তের ৪৬ ভাগের একভাগ।” অন্যত্র হাদিসে আছে- কেয়ামত তক নবীর আগমন ধারা পরিসমাপ্তি হয়েছে নবীজি হযরত মুহাম্মদ (দ.)’র আগমনের ফলে। শুধু সুস্বপ্নের ধারা রোজ কিয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে। প্রত্যেক ভাল মন্দ সুস্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ পাক জানিয়ে দিবেন।”
ইন্তেকাল ঃ এ ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ ১৯৮৬ ইংরেজী সনে ০৫ রমজান সুবহে সাদিকের সময় মহান প্রভুর সন্নিধ্যে চলে যান। ইন্তেকালের আগে ঘরে প্রায়ই ইবলিশ শয়তানকে তাড়াইতেন এবং বলতেন, এখানে তুমি কেন এসেছ? লা হাউলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজীম। উনার ইন্তেকালের অনেকদিন পর উনার বড় শাহজাদা অধ্যাপক ও এডভোকেট এ. ইউ. এম. আতাহার (ম.জি.আ) ছাহেব স্বপ্নে প্রশ্ন করলেন, আপনাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কি নেয়ামত তথা কোন আমল দ্বারা ক্ষমা করেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, “আমি আল্লাহর রাসুলের প্রেমে সর্বদা ডুবে থাকতাম তা আল্লাহ বেশী পছন্দ করেছেন।”

২৬ বছর পরে কবরে অক্ষত ঃ বিগত ২৮ফেব্রুয়ারী ২০১০ ইং, তারিখে উনার পক্ষে হতে আমি অধম প্রায় চার বছর ও উনার বড় সাহেবজাদা এডভোকেট এ ইউ এম আতাহার সাহেব স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে মাজার সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়। মাজারটি পুকুর পাড়ে হওয়াতে প্রায় মাটি চাপা পরে দাবিয়ে যায়। বার বার স্বপ্নে আদেশের পর মাটি খনন করে উনার শরীর মুবারকের উপর হতে মাটি সরিয়ে দিয়ে চারিদিকে দশ ইঞ্চি দেয়ালের উপর স্লেপ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অতি গোপনে কাজটি করা হচ্ছিল । উনার কাপনের কাপর মাথার অংশে একটু দীর্ঘ ছিল যা কারো জানা ছিল না। ২৬ বৎসর পর সে কাপড় সবার সামনে বেরিয়ে গিয়ে মাথার পাগড়িসহ দেখা যায়। ধীরে ধীরে তা এলাকায় ছড়িয়ে পরে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। পরদিন ০১ মার্চ ২০১০ সব স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় ছবি সহ সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। দিবালোকের মত স্পষ্ট ২৬ বছর একজন আল্লাহর উলিয়ে কামেল ও উনার কাপনের কাপড় অবিকল দেখে অনেকে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করেন। ইসলামের এ হক নিদর্শন দেখতে অনেক ভিন্ন ধর্মাবলম্ভীরা জড়ো হয়।

ব্যাঙ পায়ে পিষ্ঠ হলে ছাগল সাদকা:
আমার মা বলেছেন, আমার নানাজান শাহ রশিদ আহমদ নঈমী আল মাইজভান্ডারী (রা.) একদা ওয়াজ মাহফিল শেষে আসার সময় পথিমধ্যে পায়ে পিষ্ঠ হয়ে একটি ব্যাঙ মরে যায়। পরদিন তিনি একটি ছাগল ক্রয় করে সাদকা করলেন। ছোট বেলায় এ কাহিনীর মর্ম অনুধাবন করিনি। যখন কাগতিয়া এশাতুল উলুম কামিল মাদরসায় ইলমে হাদিসের উপর কামিল করছি তখন পবিত্র বুখারী শরীফের একটি হাদিস দেখে মায়ের বলা ঘটনা বুঝলাম যে, কেন নানাজান ছাগল সাদকা দিয়েছেন। হুজুর পুর নুর (দ.) ইরশাদ করেন, “কেউ যদি ভুলে ব্যাঙ হত্যা কর ছাগল সদকা দাও। কেননা এ ব্যাঙ হযরত ইব্রাহিম আলাইহিছ ছালাম অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হলে আগুন নিবানোর জন্য নবীর ভালবাসায় প্রশ্রাব করেছিল।” এ ঘটনায় প্রতিয়মান হয় উনি কতটুকু শরিয়তের হুকুম ও আমলি জিন্দেগী করেছেন।
পরিশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে ফরিয়াদ আমাদেরকে এ মহান মনিষীর দেখিয়ে দেয়া পথে মতে চলার তওফিক দান করুন। প্রত্যেক বৎসর ১৩ জানুয়ারী রাউজান থানার অন্তর্গত নোয়াপাড়া গ্রামের শেখ পাড়া গ্রামে ওরস শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। তাতে সকলে এ মনিষীর রূহানী ফয়েজ হাসিল করার দাওয়াত প্রদান করি।

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, বিনাজুরী নবীন স্কুল এণ্ড কলেজ এবং খতিব,বদুমুন্সীপাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।